শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৫৯ অপরাহ্ন
মুক্তিকামী মানুষের আপোষহীন বিপ্লবী চেতনার কাব্যগ্রন্থ‘দহন কালের কাব্য’
পর্যালোচনায়- এম এ মান্নান রিপন
প্রচার ও প্রকাশনায়// দৈনিক ঢাকার কন্ঠ
কবি শফিকুল ইসলামের চিন্তা চেতনা বা দর্শন অনেকটাই এদেশেরসাধারণ মানুষদের নিয়ে। যাদের অধিকাংশই মেহনতী শ্রমজীবী। যাদেরকেখেটে খাওয়া, সর্বহারা, সামাজিক বঞ্চিত মানব শ্রেণীকে বুঝায়। তারপ্রকাশিত তবুও বৃষ্টি আসুক, মেঘ ভাঙা রোদ্দুর, শ্রাবণ দিনের কাব্য,প্রত্যয়ী যাত্রা-সহ অন্যান্য কাব্যগ্রন্থে এ সম্পর্কে ধারণা আমরাপেয়েছি। কিন্তু আমি অনেকটা বিস্মিত হয়েছি তার ‘দহন কালের কাব্য’গ্রন্থটি পড়ে। বইটি পড়তে গিয়ে আমি বারবার আশ্চার্যিত হয়েছিবইটির প্রতিটি কবিতা পড়ে। উৎসর্গ টিকায় ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছেকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই চিরচেনা অনুপ্রাণিত উৎসাহ-উদ্দীপনারবাণীঃ-উদয়ের পথে শুনি কার বাণীভয় নাই ওরে ভয় নাই-নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দানক্ষয় নাই তার, ক্ষয় নাই…মনে হয় কবি কোন এক লক্ষ্যে আমাদেরকে নিয়ে যাওয়ার আহবানকরছেন।
প্রথমেই যে কবিতাটি চোখে পড়ে তা হল ‘সম্মুখে বাধাআছে’ শিরোনামে। তাতে রয়েছে সর্ব সমাজে সর্ব সময়েরআকাঙ্খিত মানবতার মুক্তির বাণী। কবি লিখেনঃ–সম্মুখে বাধা আছে, পথ বন্ধুরতবু জানি যেতে হবে বহুদূূর ॥পায়ে ফুটুক যতই কাটাথামলে চলবে না এ পথ হাটা-
সীমিত সময়, তবু পথ অনেক দূর ॥(সম্মুখে বাধা আছে)একটি সঠিক লক্ষ্যে পৌছার কথা কবি তার কবিতায় আহবানকরছেন। কিন্তু কবি একথাও উল্লেখ করেছেন এ পথ অনেক দীর্ঘ ও কন্টকযুক্তযেখানে পৌছতে হলে অনেক বাধা সমস্যা দেখা দিতে পারে। নিন্দা-ধিকৃতি এ পথে চির বাধা।
তা সত্বেও লক্ষ্যে পৌছুতে বিপ্লবীকে করতেহবে শক্রর মোকাবেলা। কবি লিখেনঃ–চলতে পথে শত কুমন্ত্রণাহাসিমুখে সয়ে যত যন্ত্রণা করতে হবে মোকাবিলা শক্রর ॥সত্যের পথ কুসুমিত নয়জেনেই বিপ্লবীর চলতে হয়বিপ্লবী মন পরোয়া করে না মৃত্যুর ॥ (সম্মুখে বাধা আছে)পরবর্তী কবিতায় কবি আহবান করেন সেই একই বাণী। যেখানেচিত্রিত হয়েছে সাম্য সমতার এক সুন্দর আগামী। কবি লিখেনঃ–পথ যতো হোক বন্ধুর, বন্ধু যেওনা থামিআসবেই আসবে সুন্দর আগামী ॥ (পথ যতো হোক বন্ধুর, বন্ধু যেওনা থামি)এ দুটি কবিতার বক্তব্য আমার কাছে অনেকটা পরিচিত মনে হল। আরপরিচিত মনে হবেই না কেন, এ কথাতো অধিকাংশ মুক্তিকামীস্বাধীনচিত্ত মানুষের কথা। বর্তমান সময়ে সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদীআগ্রাসনের ফলে যদিও সাধারণ মানুষকে আষ্টেপিষ্ঠে বেধে রেখে তাদেরমুখের ভাষা অনেকটা কেড়ে নিয়েছে। ভূলুন্ঠিত করেছে স্বাধীনতারস্বপ্ন, সেখানে সে কথাগুলো মানুষের কাছে অব্যক্তই থেকে যায়। কিন্তুকবিকে তা পীড়া দেয় যুগ যুগ ধরে। তাই ত্রিশের দশকে বাংলা সাহিত্যেকবিদের লেখনীতে আমরা তা লক্ষ্য করি।
যা অনেকটা গণ সংগীতের ধাচেরচিত হয়েছিল। উপরোক্ত কবিতা দু’টিতে এমনি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করাগেছে। এতে সুর দিলে সার্থক গণসংগীতই হবে। প্রাণ ফিরে পাবেকবিতার কথাগুলো মানুষের হৃদয়, মন ও মননে, গানে গানে। কারণ এতেরয়েছে শ্রেণী সংগ্রাম, বিপ্লব, জনগণের অভাব অনটন, মজুতদার, লুটেরাবা বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে বিপ্লবীদের লড়াইয়ের কথা। বাংলাদেশে গণসংগীতের প্রবক্তা কবি কাজী নজরুল ইসলাম, তাঁর‘কারার ঐ লৌহ কপাট,ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট’… এর মাধ্যমে। নজরুলপরবর্তী সময়ে এ ধরণের বক্তব্য খুব কমই শুনা গেছে। আর গেলেও তা অনেকটাছিল আপোষী ভূমিকায়। কিন্তু কবি শফিকুল ইসলাম তাঁর কবিতায় যেআপোষহীন বিপ্লবী মন্ত্রণা দিয়েছেন তা সত্যিই
সাহসী ভূমিকা
রাখে। কিন্তু কবির সার্থকতা এখানে বক্তব্যে নয় কারণ এ ধরনের বক্তব্য আমরাইতিপূর্বে অনেক লক্ষ্য করেছি। মূলত এখানে তার সার্থকতা নিহিতরয়েছে তাঁর প্রদত্ত গবংংধমব এ।
কবিতাগুলো বিশ্লেষণ করলে এই বিষয়টিপরিলক্ষিত হবে। পাশাপাশি তাঁর কবিতায় রয়েছে নির্দিষ্ট লক্ষ্য, দিকনির্দেশনা এবং লক্ষ্যে পৌছার মূলে অনেক উৎসাহ ও প্রেরণা। যেমন, কবিলিখেনঃ– আমাদের সঙ্গী জাগ্রত জনতাআমরা তো নই একা,আধারের বুক চিড়ে আমরাজাগাব আলোর রেখা ॥আমাদের আছে প্রত্যয়জয় হবেই আমাদের জয়-শুধু বিশ্বাসকে সম্বল করেআজ চলছি পথ আধার-ঢাকা ॥ (আমাদের সঙ্গী জাগ্রত জনতা)গণসংগীত ধারায় রচিত কবিতা বাংলা সাহিত্যে একটিগুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। দীর্ঘ বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ,পাকিস্তানীদের শোষণ ও বঞ্চনা স্বাধীনতা পরবর্তী দীর্ঘ সময়েস্বৈরাচারী শাসন সময়কালে এ ধারার কবিতাগুলো রচিত হয়।
ত্রিশ এর দশকেপ্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেনঃ–আমি কবি যত কামারের আর কুমোরেরকাসারের আর ছুতোরের মুটে মজুরের,আমি কবি যত ইতরের।কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায়ঃ–যাদের গভীর আস্থা আছেআজো মানুষের প্রতি,এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প বা সাধনাশকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।সেই সময়েই কবি সুকান্ত গর্জে উঠলেনঃ–বিদ্রোহ আজ, বিদ্রোহ চারিদিকেআমি যাই তার দিন পঞ্জিকা লিখে।স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আশির দশকে ও শুনা গেছে ঃ– চল চলরে কমরেড চল মুক্তি নেশায় মন উতল…।
সর্ব হারার দল, দুঃখ কিসের বল
হাতে কাস্তে হাতুড়ি, ‘কারে ভয় করি রক্ত সাগর বুকে মোদের মুক্তি শতদল।কিন্তু স্বাধীনতাত্তোর সময় থেকে দীর্ঘ ছত্রিশ বৎসর যাবত শোষণ-বঞ্চনা, অসমসামাজিক কাঠামো, সর্বত্র শ্রেণী বৈষম্যের বিভীষিকাময়রূপ, প্রতিনিয়ত মৌলিক অধিকার খর্ব, মানবাধিকার হরণ, লুন্ঠনসহএদেশের সাধারণ শ্রমজীবি কৃষক, গার্মেন্টস শ্রমিক, রাজমিস্ত্রী, পথেরধারে গগণচুম্বী প্রাসাদ তৈরীর জন্য ইট-পাথর ভাঙ্গা তরুণ-তরুণী,ডাকপিয়ন, নৈশপ্রহরী, দলিত শ্রেণী, টোকাই, বস্তিবাসী অসহায়নিঃস্ব সর্বহারা মানুষেরদের নিয়ে কবিতা তেমন রচিত হয়নি। কবিশফিকুল ইসলাম এ ক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন সংযোজন বলাযায়। ‘দহন কালের কাব্য’ গ্রন্থে তিনি এই সকল মানুষের মুক্তির চিরসত্যপথ দেখিয়েছেনঃ–আমার দেশের শ্রমিকের বলিষ্ঠ বাহুআমার সংগ্রামী উদ্দীপনা-কৃষকের ঘামে-ভেজা মুখ বাচার প্রেরণা ॥যে শ্রমিক কাজ করে কলে-কারখানায়যে কৃষক মাঠে ফসল ফলায়, সভ্যতার পথ যারা গড়ে দিলতারাই আমার স্বজন, আমার চিরচেনা ॥
(আমার দেশের শ্রমিকের বলিষ্ঠ বাহু)কবির এই অসাধারণ সৃষ্টিকর্ম বর্তমান বাংলা সাহিত্যেপ্রগতি ও উদারতার ধারায় বহুমাত্রিকতা দান করেছে। নজরুল যেখানেআজীবন বিপ্লবী হতে পারেনি (বিদ্রোহ যার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল),রবীন্দ্রনাথ যেখানে সংস্কারের বাণীতে ডুবে ছিলেন কবি শফিকুল ইসলামসেখানে অনেকটা সুকান্তের ন্যায় বিপ্লবী মূর্তি ধারণ করেছেন।নৈরাজ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের সাথে সমাজতন্ত্রের মুক্তচিন্তার লড়াইয়ে শান্তি-স্বাধীনতা কামনা করেছেন। যেখানে প্রধান শক্তিহিসাবে সাধারণ জনগণের কথা উল্লেখ করেছেন। নজরুল রবীন্দ্রসহ অন্যান্য (সুকান্ত ব্যতিত) যে সকল কবিসামাজিক শোষণ, নির্যাতনের উপর কবিতা লিখেছেন তাদের সাথে কবিশফিকুল ইসলামের পার্থক্য হল প্রথমতঃ তারা কেউই যথাযথভাবে শ্রেণী-সচেতন ছিলেন না। কেউই শোষিত জনতার সাথে সর্বাত্মকভাবেএকাত্মতা বোধ করেননি। তাদের সামগ্রিক সৃষ্টি কর্মের মধ্যে এটাক্ষুদ্র অংশের ন্যায় ছিল। কবি শফিকুল ইসলাম এ ক্ষেত্রে সকল রাজনৈতিকমতবাদের উর্ধ্বে মানবিক মতবাদের বাণী প্রচার করেছেন। সময়ের সকলদাবীর বলয়ে তার এই দর্শন,
চিন্তা অনেকটাই অগ্নিস্ফুরণ।
তাই সব শেষে বলা যায়, কবি শফিকুল ইসলাম সার্থক তাঁর এইরচনায়। তাঁর চিন্তা বেচে থাকবে যুগ যুগ ধরে যতদিন মানুষ রবে এইধরাতলে। কারণ তিনি মূলত এদেশের সর্বহারা শ্রমজীবি মানুষের জয়গাননিয়েই লিখেছেন। সেখানে খুজেছেন তাঁর আসল ঠিকানা। কবিলিখেনঃ–মাটির পৃথিবীতে যারা দিল প্রাণঅথচ যারা পেলনা সম্মানÑসেই সব শ্রমজীবি মানুষের সমাবেশ-ই আমার স্থায়ী ঠিকানা ॥ (আমার দেশের শ্রমিকের বলিষ্ঠ বাহু)।[ গ্রন্থের নামঃ দহন কালের কাব্য, লেখকঃ শফিকুল ইসলাম। প্রকাশকঃ মিজান পাবলিশার্স, ৩৮/৪ বাংলাবাজার, ঢাকাÑ ১১০০। ফোনঃ ৯৫১২৯৪৬, ৭১১১৪৩৬। মোবাইলঃ ০১৫৫২৩৯১৩৪১
প্রচার ও প্রাকাশনায় // দৈনিক ঢাকার কন্ঠ