ট্রাফিকের দুংখ কষ্ট দেখার কেউ নেই।
দৈনিক ঢাকার কন্ঠ
সোমেন মন্ডল
নিজেস্ব প্রতিবেদক
প্রখর রোদ আর অঝোর ধারার বৃষ্টিও তাদের দায়িত্বে ছেদ ঘটায় না। আবার নেই রাত-দিন। তাদের লক্ষ্য একটাই- কাজ। রাজশাহীর পথ যানজট মুক্ত করতে তাদের প্রাণপণ চেষ্টা। তারা ট্রাফিক পুলিশ। তাদের হাতের ইশারায় গাড়ি থামে। আবার সচল হয় গাড়ির চাকা। যানজটমুক্ত করতে যাদের এত কষ্ট, তাদের জীবনের চাকা কেমন ঘুরছে? আসলে তেমন সুখকর নয় তাদের জীবন।
সারা দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করার পর বাসায় গিয়ে দেখেন- নিজের বিছানায় শুয়ে আছে আরেকজন। খাবারের তালিকায় থাকে নিম্নমানের খাবার। দায়িত্ব পালনের সময় সিগন্যাল ছাড়তে দেরি হলে শুনতে হয় নানা কথা। মামলা করলে মানুষ বলে খারাপ। আর না করলে বলে টাকা খেয়ে ছেড়ে দিয়েছে। রাজশাহীর জিরোপয়েন্ট মোড়ে দায়িত্ব পালনকালে কথা হয় ট্রাফিক সার্জেন্ট হাফিজ এর সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা রোদ-বৃষ্টি ধুলাবালির মধ্যে কাজ করি।
অনেক কষ্ট হয়। বলেন, আমার অনেক বন্ধু স্নাতক পাস করে এখন বিভিন্ন ব্যাংকে ২০-২৫ হাজার টাকা বেতনে কাজ করছে। আবার অনেকে এখনো বেকার। কোনো কাজ পায়নি। সেই তুলনায় আমি ভালো আছি। তবে আমাদের দুঃখের কথা কেউ বুঝে না। আমরা সব সময় যানজট নিরসনের জন্য কাজ করি। অনেক সময় সিগন্যাল একটু দেরি করে ছাড়লে পাবলিক আমাদের বকা দেয়। বিশ্রাম নিতে ক্লান্ত শরীরে যখন বাসায় তখন হাত পা ব্যাথা শুরু হয়। দায়িত্ব পালনকালে রাস্তার ভাজাপোড়া খেয়ে আমরা সময় পার করি। নাম প্রকাশে অইচ্ছুক আরেক ট্রাফিক সদস্য জানান, কিছুদিন ধরে আমাদের খাবারে সমস্যা হচ্ছে। ডিসি স্যারের কাছে বলা হয়েছে।
তিনি আশ্বাস দিয়েছেন সমাধানের বিষয়ে। আমরা রাত দিন যেমন কষ্ট করি সেরকম আমাদের মূল্যায়ন করা হয় না। বড় বড় সিগন্যালে যারা দায়িত্ব পালন করেন তাদের অনেক বেগ পেতে হয়। ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট ও ইন্সপেক্টররা জানান, রাস্তায় দায়িত্ব পালনের সময় আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলেও সমস্যা। প্রায় প্রতিদিনই প্রভাবশালীদের কাগজপত্রসহ নানা কারণে যানবাহন আটকালেই শুরু হয়ে যায় তদবির।
প্রভাবশালীরা হুমকি-ধমকি দেয়া শুরু করেন। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে চাকরি খাওয়ারও হুমকিও দেন কেউ কেউ। মামলা করলে বলা হয় ‘ঘুষ’ না দেয়ায় মামলা দেয়া হয়েছে। মামলা না করলে বলা হয় ‘ঘুষ’ নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। ট্রাফিক পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্যরা জানান, গাড়ির কাগজপত্র চাইলে অনেক মালিক-চালকরা অনীহা দেখান। আইনের দুর্বলতার কারণে যানবাহনের চালকরাও থাকেন বেপরোয়া। আইন না মানাকে তারা গর্বের কাজ বলে মনে করেন। এমন বহুমুখী সংকটের মধ্যেই দায়িত্ব পালন করে যেতে হচ্ছে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যদের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেক ট্রাফিক সদস্য বলেন, কাঙ্ক্ষিত পদোন্নতি নেই। সামাজিক মর্যাদাও এমনকি ছুটিও তেমন নেই। দিন-রাত পরিশ্রমের পরও কোনো ধন্যবাদ নেই। দুর্ঘটনাসহ নানা ঝুঁকি তো আছেই। এরপরও যানজটের জন্য প্রতিদিন গালমন্দ শুনতে হয় সাধারণ মানুষের। ট্রাফিক বিভাগে এমনও অনেক কর্মকর্তা আছেন, যিনি ১২-১৫ বছর আগে সার্জেন্ট হিসেবে এই পেশায় যোগ দিয়ে এখনও সেই একই পদে বহাল রয়েছেন। ফলে ওই সব সার্জেন্টরা চরম মনোকষ্টে ভুগছেন। তাদের দাবি, পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত কর্মকর্তাদের ঝুঁকিভাতা দেয়ার নিয়ম থাকলেও ট্রাফিক পুলিশে কর্মরত কর্মকর্তারা ঝুঁকিভাতা পান না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ট্রাফিক সার্জেন্ট জানান, মাস্টার্স শেষে সার্জেন্ট হিসেবে ট্রাফিক পুলিশে যোগ দেন ১৫ বছর আগে। এখন পর্যন্ত তিনি একই পদে আছেন। ফলে চরম হতাশা কাজ করছে মনে। তিনি বলেন, শুধু আমি না অনেক সার্জেন্টের মধ্যে এই হতাশা কাজ করছে। অপর এক সার্জেন্ট বলেন, আমার সঙ্গের অনেকেই এখন বড় পদে কাজ করছেন। কিন্তু আমি সার্জেন্ট হিসেবে জয়েন করার পর এখন পর্যন্ত কোনো পদোন্নতি পাইনি। তিনি আরো বলেন, এছাড়া আমাদের কর্মক্ষেত্রে নানান সমস্যা আছে। জনবল ও যানবাহন সংকট সরমাঞ্জাদি, সিগন্যাল লাইটের স্বল্পতা ও আবাসন সংকটসহ নানা সমস্যা রয়েছে। তার সঙ্গে যোগ হয় রাস্তায় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নানা বিড়ম্বনা।
ট্রাফিকের টি আই মোবাক্কারুল বলেন, আমরা জনগণের সেবা করবো বলেই এই চাকরিতে জয়েন করেছি। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করি জনগণকে ভালো সার্ভিস দেয়ার জন্য। কিন্তু তারা আমাদের ভুল বোঝে। আমাদের একার পক্ষে গাড়ির চাপ সামলানো সম্ভব না। এজন্য সিটি করপোরেশনসহ নগরবাসীকে এগিয়ে আসতে হবে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ট্রাফিক পুলিশকে খুব গুরুত্ব দিচ্ছেন। তিনি ট্রাফিক নিয়ে আলাদা ভাবে চিন্তা করছেন।