রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৫৬ পূর্বাহ্ন
আজ মানুষ বড় অসহায়, কে মানুষের পাশে দাঁড়াবে
।। মোল্লা তানিয়া ইসলাম তমা ।। দৈনিক ঢাকার কন্ঠ নিউজ
কেন জানি আজ বারবার মনে পড়ছে ওপার বাংলার শক্তিমান কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সেই কবিতা – ‘মানুষ বড়ো কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও/মানুষই ফাঁদ পাতছে, তুমি পাখির মতো পাশে দাঁড়াও/ মানুষ বড়ো একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও/তোমাকে সেই সকাল থেকে তোমার মতো মনে পড়ছে/সন্ধ্যে হলে মনে পড়ছে, রাতের বেলা মনে পড়ছে/মানুষ বড়ো একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও/এসে দাঁড়াও, ভেসে দাঁড়াও এবং ভালোবেসে দাঁড়াও/মানুষ বড়ো কাঁদছে তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও/মানুষ বড়ো একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।’ কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় কত দশক আগে তার ‘দাঁড়াও’ কবিতায় মানুষের কোন বিপন্ন-বিপর্যস্ত চিত্র প্রত্যক্ষ করে এই পঙ্ক্তিগুলো লিখেছিলেন জানি না। কিন্তু এটুকু আমরা আজ বিদ্যমান বাস্তবতায় জানছি যে, মানুষ এখন বড় অসহায়।
পৃথিবী আজ বদলে দিয়েছে অতিমারী কোভিড-১৯ ।
দুনিয়ায় হাতে গোনা কয়েকটি দেশ বাদ দিলে সব দেশে মানুষ আজ অসহায় আর বিপদের মুখে। বাংলাদেশও তার বাইরে না। পাশের দেশ ভারত আমাদের চেয়ে আয়তনে- জনসংখ্যায়- জ্ঞান-বিজ্ঞানে অগ্রসর একটি দেশ। করোনার আগে দলে দলে বাংলাদেশীরা যেতেন ভারতে। সে দেশের চিকিৎসা ও সেবার প্রতি আগ্রহ ছিল দেখার মতো । সে ভারত আজ চরম বিপদে । বড় বড় শহর সহ সারা ভারতই প্রায় নাজুক অবস্থায় । সেখানে বিস্তীর্ণ সীমান্ত থাকার পরও বংলাদেশ আজ চরম ঝুঁকির মুখে ।
বাংলাদেশ যে সব ব্যবস্থা নিয়েছে বা নিচ্ছে তার কারণে এবং জনগণের ভয় ভীতি ও সমগ্র পরিবেশ মিলে বিপদে আছেন নিম্ম মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ । নিজেকে একবার প্রশ্ন করুন তো, আপনি কি আপনার বাসায় আসা গৃহ শিক্ষকের খবর নিয়েছেন একবারও? আপনি কি জানেন মধ্যবিত্ত নামে পরিচিত সাহিত্য-সংস্কৃতিসহ চাকরিজীবীর খবর কী ?
আমরা যা দেখছি বা শুনছি, তাতে এটা স্পষ্ট একেবারে গরীব এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠী কিছুটা হলেও সাহায্য পেয়েছেন, এখনো পাচ্ছেন । ঢাকা থেকে শুরু করে বড় বড় শহর মফস্বলে এমন কি গ্রামেগঞ্জেও সরকারি-বেসরকারি সাহায্যের গ্রহীতা এরাই । যারা প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ তাদের জীবনে মান-অপমানের কোন জায়গা নাই । তাদের কাছে সবার চেয়ে বড় পেটের খিদে । তাই তারা যেখানে ইচ্ছে লাইন দিতে পারেন এবং সাহায্য সংগ্রহ করতে পারেন। কিন্তু নিম্ম-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত তা পারেন না। না পারার কারণ তাদের সামাজিক মর্যাদা ও লজ্জা । আপনি একবার ভাবুন যে সংবাদকর্মী, মহল্লা এলাকায় সাংবাদিক হিসেবে সম্মানিত আজ তার কী হাল? দেশে প্রিন্ট মিডিয়ার বড় খারাপ অবস্থা এখন । করোনার সময় এটা চাউর ছিল যে নিউজ প্রিন্ট হাতে ধরলেও নাকি ভাইরাস ছড়াতে পারে ! হু হু করে নিচে নেমে গেল পত্রিকার সার্কুলেশন । সে কাগজগুলোর সাংবাদিকরা কি আগের বেতন পান? কিংবা বেতনই কি পান? তাদের কতজনের চাকরি আছে? এমন কঠিন পরিস্থিতিতে আজ অনেকগুলো খাত । তাদের নিয়ে দেশ ও রাষ্ট্রের কী ভাবনা- সেটা জানা যায় না । বাংলাদেশ
উন্নয়নশীল দেশের তকমা প্রায় নিশ্চিত বলে প্রচার প্রচারণা চলছে হরহামেশা । সেটা সত্য বলে ধরে নিলেও বলতে হয়, তাহলে কেন এসব মানুষরা সরকারের অনুদান বা সাহায্য পাবেন না? আমি বাংলাদেশে বাস করি অস্ট্রেলিয়ার তুলনা দিলে চলবে না । জনসংখ্যা কম, সম্পদ ও প্রাচুর্যে অগ্রগামী অস্ট্রেলিয়া । তারপরও সব সরকারের একটি বাজেট থাকে। সে বাজেট থেকে হঠাৎ টাকা দেওয়াটা সহজ কিছু না। তাছাড়া বাংলাদেশ যে পরিমান অনুদান ও আর্থিক অনার্থিক সাহায্য পায়, তার এক কানাকাড়িও এসব দেশ পায় না। দাতার ভূমিকায় থাকা উন্নত দেশকে অনুদান বা বাংলাদেশের মতো উপহার হিসেবে টিকা দেবে কে? কে দেবে সাহায্য? তারপরও যখন এসব দেশে করোনাভাইরাসের সময় কঠোর লকডাউন ছিল তখন চাকরি হারানো বা সাময়িক অসুবিধায় থাকা সবাইকে ভালো অংকের ডলার দিয়ে গেছে সে দেশের সরকার। যা বন্ধ করা হলো প্রায় বছর খানেক পর । জানি বাংলাদেশে এটা অসম্ভব। কিন্তু তালিকা করে সেসব চাকরি হারানো পরিবার পরিজন নিয়ে কঠিন সময় পার করা মানুষকে কি সাহায্য করা আসলেই অসম্ভব?
আমাদের দেশে ধনীর সংখ্যা আর তাদের টাকার পরিমান সম্পদের পরিমান মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো । উন্নত বা ধনীদেশের মানুষজনও এখন বাংলাদেশীদের তুলনায় ফকির। সম্পদের এ অসাম্য বণ্টন বা ভাগের কিয়দংশ থেকে করোনাভাইরাসে সৃষ্ট সংকটের ভয়াবহতায় ধুঁকতে থাকা পরিবারগুলোকে সাহায্য করা যেত। এখনো যায় ।
কিন্তু সে সময় বা তা নিয়ে ভাবার প্রয়োজন কোথায়? দেশের দিকে তাকালে তো মনে হয় করোনাভাইরাসে কারও কোন সমস্যা নেই। বরং তাদের ডুবিয়ে রাখা হয়েছে এমন কিছু চটজলদি বিষয়ে যা আফিমের মতো, খেলেই বুঁদ হয়ে থাকা যায় ! আমাদের পেটের খিদে, চোখের লাজ ও বেঁচে থাকার সংকটের চেয়েও বড় হয়ে ওঠে আনভীর কিংবা রোজিনার ইস্যু। প্রশ্ন করি, কোথায় এখন আনভীর? বলতে গেলে উঠে আসবে আরও কোন এক জটিল অথবা মুখরোচক সমস্যা। কয়েকদিনের মধ্যেই সব ইস্যুও তলিয়ে যাবে। তখন আসবে অন্য কিছু। এসব ডামাডোলে করোনার ভয়াবহতার স্বীকার হওয়া মানুষের জান যাক আর থাক- কে তোয়াক্কা করে?
সমাধানের কথা যদি বলি- তাহলে প্রথমেই আসবে সাংসদ নেতা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কথা। দেশে তাদের অন্তত কোনও অভাবে পড়তে হয় না। কেন তারা নিজ নিজ এলাকার কর্মীদের দিয়ে একটা তালিকা করান না? যে তালিকা অনুযায়ী কষ্টে থাকা, বুকে পাথর চেপে দিন পার করা- পরিবারগুলো দুই বেলা খাওয়ার সুযোগ পাবে। কেন সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে নিম্ন আয় ও মধ্যবিত্তের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা নাই? এতো যে টিভি মিডিয়া- দিনরাত টকশো- এতো এতো অনুষ্ঠান, দেখলে মনে হবে করোনাভাইরাস মানে আন্তর্জালে প্রতিভা প্রকাশের উৎসব চলছে। গান-নাচ-কবিতা-টক শো এবং সব বিষয়ে এতো আলোচনা, এতো সমাধান- অথচ করোনায় নিঃস্ব হওয়া মানুষদের জন্য কোনও ভাবনা নাই। এসব উটকো সমস্যার চাইতে বড় যে মানুষ এবং তার জীবন- সেটাই আজ ভুলে গেছি আমরা।
বাংলাদেশে নিন্ম আয় ও সঞ্চয়ের ওপর নির্ভরশীল মানুষ বড় কষ্টে আছেন। তাদের হাহাকার ও নিরব কষ্ট স্পর্শ করতে না পারার বেদনা বা পাপ কি আমাদের মার্জনা করবে? কথায় কথায় বঙ্গবন্ধু ও তার স্বপ্নের কথা বললেও, কেউ তার পথ অনুসরণ করে না। বঙ্গবন্ধুর মতো সহজ জীবন, সরল চিন্তা বা সাধারণ পোশাকও নাই নেতাদের। সমাজের সর্বত্র খাই খাই ভাবের ভেতর এককোণে চুপ থাকা মধ্যবিত্ত, নিম্ম মধ্যবিত্ত আর জীবিকা নিয়ে সংকটে থাকা মানুষদের পাশে দাঁড়াতে ব্যর্থ হলে সময় ছেড়ে কথা বলবে না । মনে রাখতে হবে এ মহামারী সহজে যাবার নয় । মানুষ না থাকলে, আর মানুষ ভালো না থাকলে- কী হবে সেতু দিয়ে? কী হবে উন্নয়নে?
মানুষ বড় কাঁদছে , মানুষের পাশে দাঁড়াও- হে মানুষ