সোহেল খান দূর্জয় নেত্রকোনা :
বিয়ে মানব জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তাই, বিয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা ধরনের আনুষ্ঠানিকতা। আর এসব আচার-অনুষ্ঠান একেক অঞ্চলে বা একেক সমাজে একেক রকম। তেমনি হাওড়াঞ্চলের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় সুদীর্ঘকাল ধরে চর্চিত হয়ে আসা এক অত্যাবশ্যকীয় অনুষঙ্গ হচ্ছে ‘ধামাইল গান’। সাধারণত হিন্দু সম্প্রদায়ের বিয়েতে এ গানের আয়োজন করা হয়। আর তা পরিবেশন করেন নারীরা। কালের বিবর্তনে অনেক সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানের পরিবর্তন ঘটলেও নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার বা বৃহত্তর সিলেটের গ্রামাঞ্চলে এখনো ধামাইল গান টিকে আছে।
কবে-কখন ধামাইল গানের উদ্ভব হয়েছিলো তা জানা না গেলেও ধারণা করা হয়, এটি লোকগানের প্রাচীন এক অনুষঙ্গ। কারণ, মধ্যযুগের কবিদের একাধিক সাহিত্য-নিদর্শনে ‘ধামালি’ শব্দের ব্যবহার রয়েছে। বিশেষ করে শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে বহুবার ব্যবহার করা হয়েছে শব্দটি। আবার মহাকবি সঞ্জয় রচিত মহাভারতেও আছে ‘ধামালি’ শব্দের ব্যবহার। সে যাই হোক, ধামাইল গানের বিকাশে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখে গেছেন মরমী কবি রাধারমণ দত্ত। পল্লীর নারীর হৃদয়ের গভীর আকুতিকে রাধা-কৃষ্ণের চরিত্রের মধ্য দিয়ে ধামাইল গানে অত্যন্ত সুচারুরূপে প্রকাশ করেছেন তিনি। তাই ধামাইল ও রাধারমণ শব্দ দুটি এখন প্রায় সমার্থক।
হাওড়-গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের বিয়ের বিভিন্ন পর্বে, বিশেষ করে মঙ্গলাচরণ, গায়ে হলুদ, জলভরা, দ্বিরাগমন প্রভৃতি উপলক্ষে ধামাইল গানের আয়োজন করা হয়। তবে সবচেয়ে বেশি করা হয় জলভরার পর্বে। ওই সময় নারীরা পুকুর বা নদী থেকে কলসি ভরে পানি আনেন। এর পর বর বা কনেকে (কোনো কোনো এলাকায় তাদের ভগ্নিপতিকেও রাখা হয়) পরিবেশন স্থানের মাঝখানে চেয়ার, জলচৌকি কিংবা পিঁড়িতে বসিয়ে তার সামনে পানিভর্তি কলসিগুলো সাজিয়ে রাখেন। কলসি ছাড়াও পাত্র-পাত্রীর সামনে রাখা হয় লুঙ্গি, গামছা, সিঁদুর, সাবান, কাঁচা হলুদ, গিলা, ধান, দূর্বা, কুলা, ফুল, প্রদীপ প্রভৃতি। গায়িকারা বর বা কনের চারপাশে বৃত্তাকারে ঘুরে গান পরিবেশন করেন। গান শেষে কলসির পানি এবং সাবান-হলুদ দিয়ে বর-কনে ও তাদের ভগ্নিপতিকে স্নান করান। স্নানের পর তাদের উপহার হিসেবে দেন শাড়ি, ব্লাউজ, গেঞ্জি, লুঙ্গি বা জামা-প্যান্টের কাপড়। আবার বরের পক্ষ থেকেও গায়িকাদের দেওয়া হয় সাধ্যমতো বকশিশ।
ধামাইল গান পরিবেশনের রীতি-রেওয়াজ কিছুটা ভিন্ন বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। এর সুর বা গায়নরীতিও আলাদা। মূলত ছন্দোবদ্ধ করতালির মাধ্যমে এ গানের তাল ও লয় নিয়ন্ত্রণ করা হয়। হাওড়াঞ্চলে এ করতালিকে বলা হয় ‘থাপা’। শুরুর দিকে থেমে থেমে একটি করে থাপা দিয়ে অত্যন্ত ধীর লয়ে গান ধরা হয়। কিন্তু খানিক পরেই বাড়তে থাকে থাপার পরিমাণ। এক পর্যায়ে গানের সুর অত্যন্ত দ্রুত লয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। আবার শেষদিকে ফিরে আসা হয় ধীর লয়ে। গানের শুরুতে প্রথমে একজন মূল গায়িকা গান ধরেন।
তিনি এক-দুটি চরণ গাওয়ার পর বাকিরা তার সঙ্গে কণ্ঠ মেলান এবং বৃত্তাকারে নৃত্যসহযোগে ঘুরতে থাকেন। একটি গানের আসরে সাধারণত সাত থেকে সর্বোচ্চ ২০জন পর্যন্ত গায়িকা থাকেন। ধামাইল গানে কোনো মঞ্চের প্রয়োজন হয় না। বাড়ির খোলা উঠানই ধামাইল গানের উপযুক্ত জায়গা। আগে এ গানে কোনো বাদ্যবাজনার ব্যবহার দেখা যেত না। ইদানীংকালে কোথাও কোথাও ঢোল বা মন্দিরা বাজানো হয়।
ধামাইল গানের আবার বিভিন্ন পর্ব রয়েছে। যেমন : বন্দনা, আসর, বাঁশি, জলভরা, গৌররূপ, শ্যামরূপ, বিচ্ছেদ, কোকিল সংবাদ, কুঞ্জ সাজানি, স্বপন, চন্দ্রার কুঞ্জ, মানভঞ্জন, মিলন, সাক্ষাৎ খেদ, বিদায় বা আউট গান। একেক পর্বে একেক ধরনের গান গাওয়া হয়। তবে গানের মূল বিষয়বস্তুর মধ্যে থাকে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম কাহিনী। সুদীর্ঘকাল ধরে সামাজিক আচার হিসেবে এটি চর্চা হয়ে এলেও দিনে দিনে ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে মিশে গেছে। তাই বর বা কনের মঙ্গল কামনার্থেই গাওয়া হয় এ গান।
ধামাইল গান শিখতে কোনো প্রশিক্ষণ লাগে না। অন্যদেরকে দেখতে দেখতে বা তাদের অনুকরণে গাইতে গাইতেই শেখা হয়ে যায়। তাছাড়া এ গানের শিল্পীদের নির্ধারিত হারে কোনো পারিশ্রমিক বা সম্মানীও দিতে হয় না। তবে সাম্প্রতিককালে আয়োজকদের কেউ কেউ সামান্য বকশিশ দিয়ে থাকেন। নেত্রকোনার খালিয়াজুরী উপজেলার নগর, চাকুয়া, মদনের মাঘান, মোহনগঞ্জের সোয়াইর, মাঘান এবং কলমাকান্দার বড়খাপন ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে এ ধরনের বেশকিছু দল আছেÑ যারা বিয়ের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত শিল্পী হিসেবে ধামাইল গান পরিবেশন করে থাকেন। খালিয়াজুরীর নয়াগাঁও গ্রামে গড়ে ওঠা এমনই একটি দলের নাম ‘মহুয়া ধামাইল দল’। ধামাইল গানের ঐতিহ্য রক্ষায় ওই গ্রামের ১২ নারী প্রায় তিন বছর আগে দলটি গঠন করেন। গঠনের পর থেকে তারা নিয়মিতভাবে ধামাইল গানের চর্চা ও প্রচার করে যাচ্ছেন। গৃহিণী উষা রানী সরকার ও উচ্চ শিক্ষিতা নারী শেফালী রানী সরকার দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দলের অন্য ১০ সদস্যের মধ্যে রয়েছেন: বাংলা সাহিত্যে অনার্স পাস করা সুপ্তা সরকার, স্নাতক পাস করা বিউটি সরকার, উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী প্রিয়াংকা সরকার, এসএসসির শিক্ষার্থী প্রিজা তালুকদার, নবম শ্রেণির হীরা সরকার, সপ্তম শ্রেণির ঐষী তালুকদার ও লক্ষ্মী সরকার এবং গৃহিণী আল্পনা সরকার, বাণী পুরকায়স্থ এবং লিপ্টি পুরকায়স্থ।
শেফালী সরকার বলেন, কিশোরী থাকাকালে মা-মাসিদের দেখে ধামাইল গান রপ্ত করেছিলাম। একটু বড় হয়ে লক্ষ্য করি, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের এ গানের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। তাদের হিন্দি বা ব্যান্ড সঙ্গীতের দিকে আগ্রহ বেশি। এ বিষয়টি মাথায় নিয়েই গ্রামের আরও কয়েক নারীকে সংগঠিত করে দলটি গঠন করেছিলাম। তিনি আরও জানান, তিন বছরে বিভিন্ন গ্রামের বিয়ে-শাদিতে অন্তত তিন শতাধিক অনুষ্ঠান করেছেন তারা। একমাত্র বোরো ফসলনির্ভর এ অঞ্চলে বর্ষার প্রায় আটমাস কোনো কাজ থাকে না। তাই বিয়ে-শাদির জন্য ওই সময়টাকেই বেছে নেন হাওড়ের বাসিন্দারা। এ কারণে বর্ষা মৌসুমেই ধামাইল গানের আয়োজন বেশি হয়। তখন দূর-দূরান্তের বহু গ্রামের আয়োজকরা এসে নৌকাযোগে নিয়ে যায় তাদের। গান পরিবেশনের জন্য কোনো পারিশ্রমিক নেই না। এটি শখের বশে করি। তবে যারা আয়োজন করেন তারা যাতায়াত খরচ দেন, যোগ করেন শেফালী।
খালিয়াজুরীর উদয়পুর গ্রামের ধামাইল শিল্পী সাবিত্রী রানী সামন্ত জানান, যাদের বাড়িতে বিয়ের আয়োজন করা হয় তারা আগে থেকেই ধামাইল দলকে আমন্ত্রণ জানান। তিনি বলেন, বিয়ে ছাড়াও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সীমন্তোন্নয়ন, নবজাতকের ষষ্ঠী, মাসিক ব্রত, অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠানেও শখ করে ধামাইল গানের আয়োজন করা হয়।