মিজানুর রহমান নওগাঁ প্রতিনিধি :
নাতি মারা গিয়ে ছয় মাসও পেরোয়নি। এখানে দাফন করেছিলাম। শশুড়-শাশুড়ির কবরও ছিলো কাছাকাছি। সবকটি কবর উপড়ে ফেলা হয়েছে। নাতির শেষ চিহ্নটাও মুছে ফেলো দিলো তারা। আমি আমার নাতির কবর আগের জায়গায় ফিরে চাই। শুক্রবার (০২ জুন) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার এনায়েতপুর ইউনিয়নের কালুশহর গ্রামের বিশাহারা কবরস্থানের পাশে মাটিতে বসে কাঁদতে কাঁদতে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন পাশ^বর্তী ইটালি গ্রামের বয়জৈষ্ঠ আমেনা খাতুন।
শুধু আমেনা খাতুন নয়। এনায়েতপুর ইউনিয়নের কালুশহর, ইটালিসহ আশেপাশের অন্তত ৫টি মহল্লার শত শত বাসিন্দা শুক্রবার সকাল থেকেই এই কবরস্থানের পাশে এসে ভীড় জমাচ্ছেন। একদিন আগেও যেখানে অর্ধশত কবর দৃশ্যমান ছিলো তা গত বৃহস্পতিবার (০১ জুন) রাতে এক্সকাভেটর দিয়ে উপড়ে ফেলা হয়েছে। এই কাজটি করেছেন কবরস্থানের সাড়ে ৩ শতক জমির দাবীদার ইটালি গ্রামের মৃত জয়নাল আবেদিনের স্ত্রী মোছা. কল্পনা। বিষয়টি জানা মাত্র তা প্রতিহত করে ওই রাতেই মোছা. কল্পনা ও তার বাবা আবদুল লতিফের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে মহাদেবপুর থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন গ্রামবাসীরা।
গ্রামবাসীদের অভিযোগ, বিশাহারা কবরস্থানটি শত বছরের পুরনো। জয়নাল আবেদিন ও জাহিদুল ইসলামের পূর্ব পুরুষরা কবরস্থান তৈরীতে ৭ শতক জমি মৌখিকভাবে দান করেছিলো। তারপর থেকেই আশেপাশের ৫টি মহল্লার প্রায় ৫০০টি পরিবার তাঁদের স্বজনদের এখানে কবর দিতো। জয়নাল আবেদিনের মৃত্যুর পর থেকেই তার স্ত্রী ও শশুড় অবৈধভাবে কবরস্থানটি উচ্ছেদ চেষ্টা শুরু করে। শুরু থেকেই স্থানীয়রা এতে বাঁধা দিতো। পরে সুকৌশলে বৃহস্পতিবার রাত ৮টার দিকে এক্সকাভেটর দিয়ে অর্ধশত কবর উচ্ছেদ করা হয়েছে।
কালুশহর সাহাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ফাইজুল ইসলাম বলেন, এখানে আত্মীয় স্বজন প্রত্যেকের কবর আছে। ২০টি’র মতো কবর নিজে খুঁড়েছি। শতবর্ষী কবরস্থান হওয়ায় আশেপাশের গ্রামের প্রত্যেকেই এখানে দাফন করতে আসেন। সেই কবরস্থানকে নিশ্চিহ্ন করতে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। রাতের আঁধারে মাটি কাটা মেশিন (এক্সকাভেটর) নামিয়ে ২ শতক জমির কবরস্থান উচ্ছেদ করা হয়েছে। যারা এই নিকৃষ্ট কাজ করেছে তাঁদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত।
কালুশহর গ্রামের বয়জৈষ্ঠ সাহের উদ্দিন, আফাজ উদ্দিন ও শহিদুল ইসলাম বলেন, জয়নাল এবং জাহিদুল দুজনের ৭ শতক জমি কবরস্থানের মধ্যে আছে। এটা তারা বা তাঁদের পূর্বপুরুষরা কখনোই ভাগাভাগির চিন্তা করেনি। জয়নালের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী কল্পনা ও তার শ^শুড় আব্দুল লতিফের নজর পড়েছে এই জমির উপর। জাহিদুল এর প্রতিবাদ শুরু থেকেই করে আসছিলো। তবে সম্প্রতি জাহিদুল প্রবাসে থাকার সুযোগে জয়নালের স্ত্রী কবরস্থানটি উচ্ছেদে মরিয়া হয়ে উঠে এবং শুক্রবার রাতে কবরস্থান লন্ডভন্ড করে দেয়। সকাল থেকে গ্রামে হাহাকার পড়ে গেছে। যা গ্রামবাসীর ধর্মীয় অনুভূতিতে চরম আঘাত হেনেছে। এর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে এলাকায় যেকোনো মুহুর্তে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটতে পারে।
কবরস্থানের জমিদাতা কুয়েত প্রবাসী জাহিদুলের স্ত্রী আরিফা খাতুন বলেন, কবরস্থানের ভেতরে থাকা জমি ভাগাভাগির জন্য প্রায়ই ঝামেলা করতো কল্পনা। পরে বাধ্য হয়ে তাকে অন্যত্র সাড়ে ৩ শতক জমি বুঝে দিতে রাজি হয়েছিলাম। কল্পনা সেটি না নিয়ে আমাদের ১০ শতক জমি জবরদখল করে নিয়েছে। পূর্ব পুরুষদের কবর রক্ষায় এতেও আমরা বাঁধা দিইনি। এরপরেও সে অন্যায়ভাবে কবরস্থান ভাঙচুর করেছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মোছা. কল্পনা বলেন, কবরস্থানের ভেতরে আমাদের আরো জমি আছে। গ্রামবাসীরা বছরের পর বছর সেটি ব্যবহার করছে। কখনো বাঁধা দেয়া হয়নি। সেখান থেকে কিছু জমি কেটে সমতল করা হয়েছে। পুরনো কবরগুলো নষ্ট করা হয়নি। অভিযোগটি মিথ্যা ও ভিত্তীহিন বলে দাবী করেন তিনি।
স্থানীয় কালুশহর ৫ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য শাহজাহান হোসেন বলেন, শতবর্ষী পুরনো বিশাহারা কবরস্থানের পাশে সকাল থেকেই স্থানীয়রা ভীড় জমাচ্ছেন। এক রাতের মধ্যে স্বজনদের শেষ চিহ্ন মিশে যাওয়ার দৃশ্য কেউই মেনে নিতে পারছেন না। গ্রামে হাহাকার পড়ে গেছে। অন্তত ৫০০টি পরিবার যে কবরস্থানে স্বজনদের দাফন করেন সেটি অবৈধভাবে উচ্ছেদ চেষ্টা করা হচ্ছে। যারা এটি করেছেন তাঁদেরকে অবিলম্বে আইনের আওতায় আনার দাবী জানান তিনি।
মহাদেবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোজাফফর হোসেন বলেন, কবরস্থান ভাঙচুরের ঘটনায় শুক্রবার রাতে গ্রামবাসীরা বাদী হয়ে একটি অভিযোগ দিয়েছেন। শনিবার দুপুরে থানা পুলিশের একটি টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।