দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনে ৪৮ জন দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে আওয়ামী লীগ। বুধবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) বিকালে সাড়ে ৫টার দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবনে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এসময় তাঁর সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘১৫৫৩ জনের মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই শেষে সংরক্ষিত আসনের জন্য ৪৮টি বেছে নিতে হয়েছে। সভাপতি শেখ হাসিনার অনুমতিক্রমে সর্বসম্মতিক্রমে ৪৮টি আসনের আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী মনোনয়ন দেয়া হয়েছে।
নিয়ম অনুযায়ী, জনগণের ভোটে নির্বাচিত ৩০০ এমপির ভোটে সংরক্ষিত নারী আসনের ৫০ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন। তবে, অতীতে ভোট হওয়ার কোনো নজির নেই। এবারও ভোট হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। ফলে মনোনীতরা সকলেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে চলেছেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসনের সংখ্যানুপাতে আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত নারী সদস্য মনোনয়ন দেওয়ার কথা ছিল ৩৮টি। কিন্তু, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচিত ৬২ জন সংসদ সদস্য সবাই আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ায় তারা দলের সভানেত্রী ও সংসদ নেত্রী শেখ হাসিনার ওপর তাদের ভাগের ১০ জন সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্যকে মনোনয়ন দেওয়ার ভার অর্পণ করেন। এ কারণে আওয়ামী লীগ মোট ৪৮ আসনে সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্যদের মনোনয়ন চূড়ান্ত করেছে।
সংরক্ষিত আসনের মনোনয়নের ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুরাতনের মাজখানে নতুন মুখের সমাবেশ ঘটিয়েছেন। এতে দলের ত্যাগী নেত্রী, ত্যাগী পরিবার, প্রবীন আওয়ামী লীগ নেতার সন্তান, সমাজের আলোকিত ও পেশাজীবী নারীকেও বেছে নেওয়া হয়েছে।
মনোনয়ন পাওয়াদের মধ্যে ৫ জন একাদশ জাতীয় সংসদেও সদস্য ছিলেন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন নিয়ে পরাজিত হওয়া, নৌকার মনোনয়ন পাওয়ার পর আদালতের আদেশে বাদ পড়া, আবার দলীয় মনোনয়ন চেয়েও বাদ পড়া নেত্রীরাও স্থান দেওয়া হয়েছে।
১৪-দলীয় জোটের শরিক গণতন্ত্রী পার্টি থেকেও একজনকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে।
এর আগে গত ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়ে ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনের দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি করে আওয়ামী লীগ। ৪৮টি আসনের বিপরীতে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন ১৫৪৯জন। এরপর বুধবার দুপুর ১২টার দিকে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে গণভবনে সংরক্ষিত নারী আসনের মনোনয়ন বোর্ড সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় দলীয় প্রার্থীর নাম চূড়ান্ত করা হয়।
নির্বাচনের তফসিল অনুযায়ী ১৮ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশনে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে মনোনয়নপত্র জমা দেবেন আওয়ামী লীগের এসব প্রার্থী। এদিকে রাতেই রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে প্রার্থী তালিকা পাঠিয়েছে আওয়ামী লীগ। চিঠিতে বলা হয়েছে আওয়ামী লীগ, জোটভুক্ত ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যের অনুকূলে প্রাপ্ত ৪৮টি সংরক্ষিত আসনে প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রদান করা হলো। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে চিঠিতে।
যারা মনোনয়ন পেলেন-
রেজিয়া ইসলাম (পঞ্চগড়)
দ্রৌপদী দেবি আগরওয়াল (ঠাকুরগাঁও)
আশিকা সুলতানা (নীলফামারী)
রোকেয়া সুলতানা (জয়পুরহাট)
আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য সম্পাদক কোহেলী কুদ্দুস মুক্তি (নাটোর)
জারা জেবিন মাহবুব (চাঁপাইনবাবগঞ্জ)
রুনু রেজা (খুলনা)
ফরিদা আক্তার বানু (বাগেরহাট)
ফারজানা সুমি (বরগুনা)
খালেদা বাহার বিউটি (ভোলা)
নাজনীন নাহার রোশা (পটুয়াখালী)
ফরিদা ইয়াসমিন (নরসিংদী)
উম্মে ফারজানা সাত্তার (ময়মনসিংহ)
নাদিরা বিনতে আমির (নেত্রকোনা)
মাহফুজা সুলতানা মলি (জয়পুরহাট)
পারভীন জামান কল্পনা (ঝিনাইদহ)
আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য আরমা দত্ত (কুমিল্লা)
লায়লা পারভীন (সাতক্ষীরা)
সদ্যসাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ান (খুলনা)
বেদৌড়া আহমেদ সালাম (গোপালগঞ্জ)
শবনম জাহান (ঢাকা)
পারুল আক্তার (ঢাকা)
সাবেরা বেগম (ঢাকা)
শাম্মী আহমেদ (বরিশাল)
আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পাদক নাহিদ ইজহার খান (ঢাকা)
অনিমা মুক্তি গোমেজ (ঢাকা)
শেখ আনার কলি পুতুল (ঢাকা)
মাসুদা সিদ্দিক রোজি (নরসিংদী)
তারানা হালিম (টাঙ্গাইল)
আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য শামসুন নাহার (টাঙ্গাইল)
আওয়ামী লীগের শিক্ষা সম্পাদক মেহের আফরোজ চুমকি (গাজীপুর)
অপরাজিতা হক (টাঙ্গাইল)
হাসিনা বারী চৌধুরী (ঢাকা)
নাজমা আক্তার (গোপালগঞ্জ)
রুমা চক্রবর্তী (সিলেট)
ফরিদুন্নাহার লাইলী (লক্ষ্মীপুর)
আওয়ামী লীগের কৃষি সম্পাদক আশরাফুন নেছা (লক্ষ্মীপুর)
কানন আরা বেগম (নোয়াখালী)
শামীমা হারুন লুবনা (চট্টগ্রাম)
ফরিদা খানম (নোয়াখালী)
দিলারা ইউসুফ (চট্টগ্রাম)
ওয়াসিকা আয়শা খান (চট্টগ্রাম)
আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক ডরথি তঞ্চঙ্গ্যা (রাঙামাটি)
সানজিদা খানম (ঢাকা)
আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য নাছিমা জামান ববি (রংপুর)
১৪ দলীয় জোটের শরিকদের মধ্য থেকে একমাত্র মনোনীত প্রার্থী গণতন্ত্রী পার্টির কানন আরা বেগম।
ঘোষিত তালিকা অনুযায়ী, এবারই প্রথম জাতীয় প্রেস ক্লাবের প্রথম নারী সাধারণ সম্পাদক ও প্রথম সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন মনোনয়ন পেয়েছেন। তিনি জাতীয় প্রেস ক্লাবের দুবার সাধারণ সম্পাদক ও দুবার সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়েছেন। বর্তমানে সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। ফরিদা ইয়াসমিন নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য।
তাছাড়া সাবেক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি, তারানা হালিম, আরমা দত্ত, ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা মনোনয়ন পেয়েছেন। মনোনয়ন পেয়েছেন সানজিদা খানম, ফরিদুন্নাহার লাইলী, নাজমা আক্তার, ওয়াসিকা আয়শা খান, কোহেলী কুদ্দুস মুক্তি, রোকেয়া সুলতানার মতো চেনা সব মুখও।
মনোনয়ন পাওয়াদের মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনি লড়াইয়ে হেরে যান সানজিদা খানম ও মেহের আফরোজ চুমকি। মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মেহের আফরোজ চুমকি গত তিন সংসদে গাজীপুর-৫ আসনের এমপি ছিলেন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৪ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হয়েছিলেন দলটির কার্যনির্বাহী সদস্য সানজিদা খানম। তিনি নবম সংসদে এ আসনের এমপি ছিলেন। আর ওয়াসিকা আয়শা খান, অপরাজিতা হক, ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা, নাহিদ ইজহার খান ও আরমা দত্ত একাদশ জাতীয় সংসদেও এমপি পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তারানা হালিম এর আগেও এমপি ছিলেন।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক পেলেও উচ্চ আদালতের রায়ে প্রার্থিতা বাতিল হওয়া আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেত্রী ড. শাম্মী আহমেদও পেয়েছেন মনোনয়ন। দলের আন্তর্জাতিক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে বরিশাল-৪ আসনে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। কিন্তু দ্বৈত নাগরিকত্বের কারণে তাঁর মনোনয়ন বাতিল হয়ে যায়। অপরদিকে, মনোনয়ন চেয়েও না পাওয়া সাবেক শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ান, ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরাকে সংরক্ষিত আসনে এমপি পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেত্রীদের মধ্যে মনোনয়ন পেয়েছেন অর্থ ও পরিকল্পনা সম্পাদক ওয়াসিকা আয়শা খান। তিনি টানা তিনবার সংসদ সদস্য হচ্ছেন। কৃষি ও সমবায় সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-৪ আসনের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। কিন্তু জাসদকে আসনটি ছেড়ে দেওয়ার কারণে তাঁর মনোনয়ন প্রত্যাহার করা হয়। তিনি নবম জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে এমপি ছিলেন।
আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক শামসুন নাহার চাঁপা প্রথমবারের মতো মনোনয়ন পেয়েছেন। দলের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক রোকেয়া সুলতানা এবার প্রথম মনোনয়ন পেলেন। প্রথমবারের মতো মনোনয়ন পেয়েছেন দলটির আরেক কার্যনির্বাহী সদস্য পারভীন জামান কল্পনা।
যুব মহিলা লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নাজমা আকতার এর আগেও সংরক্ষিত আসনে এমপি ছিলেন। তিনি এবারও মনোনয়ন পেয়েছেন।
দ্বাদশেও মনোনয়ন পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী ডাকসুর সাবেক ভিপি আখতারুজ্জামানের কাছে পরাজিত হন। এবার তিনি সংরক্ষিত আসনে এমপি হচ্ছেন। কোহেলী কুদ্দুস মুক্তি মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজশাহী জেলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি, পরে নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবদুল কুদ্দুসের মেয়ে। এ ছাড়া মুক্তি ছাত্রলীগ ও যুব মহিলা লীগের নেত্রী ছিলেন।
সিলেট থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন রুমা চক্রবর্তী। একেবারেই তৃণমূল পর্যায়ের কর্মী তিনি। ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান পরে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর মালিকানায় নিজের কোনো বাড়িঘর নেই। এ মনোনয়ন চমক হিসেবেই দেখছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ।
রংপুর থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন নাসিমা জামান ববি। তিনি রংপুর সদর উপজেলা পরিষদে পরপর তিনবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
পঞ্চগড় থেকে সংরক্ষিত নারী আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন রেজিয়া ইসলাম। তিনি পঞ্চগড় জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তাঁর স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম নুরু ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের পরপর দুবারের সাধারণ সম্পাদক। রেজিয়ার ছেলে আনোয়ার সাদত সম্রাট বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। স্থানীয়দের ধারণা, রেজিয়াকে মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনীতিতে তাঁর নিজের ত্যাগ ও পারিবারিকভাবে আওয়ামী লীগের প্রতি ভালোবাসা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, দ্বাদশ সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার তারিখ ১৮ ফেব্রুয়ারি রবিবার সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত। মনোনয়নপত্র বাছাই করা হবে ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি। আপিল দায়ের ২২ ফেব্রুয়ারি এবং আপিল নিষ্পত্তি হবে ২৪ ফেব্রুয়ারি। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ২৫ ফেব্রুয়ারি, প্রতীক বরাদ্দ ২৭ ফেব্রুয়ারি এবং ভোট গ্রহণ হবে ১৪ মার্চ।