বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৯ অপরাহ্ন
সাংবাদিকের দিশা- ১
মাফ করে দিয়েন বাউলসম্রাট। আপনার গান নিয়ে প্যারোডি করার স্পর্ধা আমার কেন, দুনিয়ার কারোর নাই। স্পর্ধা-দুঃসাহস শুধু না, অধিকারও নাই কারো। আসলে এটা প্যারোডি না সম্রাট, এটা ট্র্যাজেডি। বড় দুঃখে বের হলো এই চরণগুলো। আপনার চরণধূলি আমার পোড়ামুখে ছুড়ে মেরে ক্ষমা করে দিয়েন।
এবার দুঃখটা বলি। আপনিই তো গেয়ে গেছেন, ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম আমরা….’। এই আগে মানে কতো আগে, হিসাব করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আপনি এই গানটা বেঁধেছেন কতো সালে, অনেক চেষ্টা করেও জানতে পারিনি। তাই তখন আপনার বয়স ঠিক কতো ছিল, তাও জানতে পারিনি। এই ধরাধাম আপনার চরণধুলায় ধন্য হয়েছে ৯৩টি বছর। এর মাঝামাঝি কোনো এক সময়েও যদি গানটা আপনি বেঁধে থাকেন, তখন থেকে আপনার কিশোর-তরুণ বয়সে, যখন ‘কী সুন্দর দিন কাটাইতেন’, তখন আপনার বয়স ছিল ১৮, ২০ কি ২৫ বছর! তার মানে, মাত্র দুই-তিন দশকের মধ্যেই আপনি নিজের চোখে দেখতে পেলেন, ‘কী সুন্দর দিন’গুলো ‘অসুন্দর’ হয়ে গেল। আজ ২০২৪ সালের ১৮ মার্চ। ধরে নেয়া যায়, আপনার দেখা সেই ‘অসুন্দর’ দিনগুলোর পর কেটে গেছে আরো চার-পাঁচটি দশক; এবং আরো অনেক দ্রুতগতিতে অপসৃত হয়েছে শুভ-সুন্দর-মঙ্গল। এখন যারা, আমাদের মতো হতভাগারা এই ধরাধামে বিচরণ করছি, তারা এখন কী গান গাইবো, আপনিই বলেন! আমাদের দিনগুলো আজ কেমন দাঁড়িয়েছে, শুনবেন বাউলসম্রাট?
আপনি গেয়ে গেছেন, ‘গাড়ি চলে না চলে না চলে না রে……’। আর এখন পৃথিবীতে শুধু গাড়িই চলে। মাটিতে, পানিতে, আকাশে শুধু গাড়ি আর গাড়ি। আকাশেও ট্রাফিক পুলিশ বসানোর জো হয়ে গেছে। এতোসব গাড়ি চালাতে লাগে তেল-গ্যাস-কয়লা। মাটি খুঁড়ে পাতাল থেকে বের করে আনা হচ্ছে সেইসব জীবাশ্ম জ্বালানি। দেদারসে চালানো হচ্ছে গাড়ি-জাহাজ-উড়োজাহাজ, হিটার-মিটার-জেনারেটর, বিদ্যুৎ-ব্যাটারি-চার্জার, মেশিন-কলকারখানা-যুদ্ধাস্ত্র- আরো কতো কী! এসব চালাতে গিয়ে বের হচ্ছে কার্বনের মাত্রাঅতিরিক্ত বিষাক্ত গ্যাস। ছড়িয়ে পড়ছে আকাশে-বাতাসে-পানিতে। গরম হয়ে উঠছে বায়ুমণ্ডল-ধরাতল। সবুজ পুড়িয়ে ছাড়খার করছে দাবানল। গরমে ফুলে-ফেঁপে উঠছে সাত সাগরের পানি। লবণপানি ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে। তাপে গলে যাচ্ছে পাহাড়চূড়ার বরফ। হিমালয়ের হিমবাহও গলতে শুরু করেছে। কবে যে ‘বরফ গলা নদী’র স্রোত সাধের কমলগজ্ঞ থেকে আমারে ভাসিয়ে নিয়ে বঙ্গোপসাগরে ফেলে দিয়ে আসে! গাছ-পাহাড়ে উঠেও যদি বা রক্ষা পাই, তাতেও কি শেষরক্ষা হবে? হিমবাহের নিচে চাপা পড়ে জীবন্ত হয়ে আছে লক্ষ-কোটি বছর আগের কতজাতী ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাস-জীবাণু। বেরিয়ে এসে সেগুলো তুমুল আনন্দে ছড়িয়ে পড়বে দেশে দেশে; আকাশে-বাতাসে-মাটিতে। কোভিডের চেয়েও যদি শক্তিধর হয়ে ওঠে ওরা? কোথায় পালাবে মানুষ?
এখনই তো সেই আলামত দেখতে পাচ্ছি স্পষ্ট। আমার ঘরে ভাইরাস। প্রেতিবেশীল ঘরে ভাইরাস। বাচ্চারা আক্রান্ত। বড়রা আক্রান্ত। জ্বর-ঠাণ্ডা-কাশি। কফের সঙ্গে তাজা রক্ত। চিকিৎসা নিতে গিয়ে দেখি, একী! ঘরে ঘরে যেন একই অবস্থা! ছোট-বড়-বয়স্ক কেউ সুস্থ নাই। শুধু এদেশেই না, অন্য দেশেও তাই। পুবপ্রান্তে থাইল্যান্ডে থিতু হওয়া এক সাবেক সহকর্মীকে ফোন দিই। ওখানেও ভাইরাস। পশ্চিম প্রান্তে কানাডায় স্থায়ী আমার সাবেক বাড়িওয়ালি ফোন দিয়ে জানান, তাদেরও ঘরে ঘরে ভাইরাস।
বাউলসম্রাট শাহ আব্দুল করিম, আপনার এই ভাটির দেশে সাধ করে এসে আজ কী গান গাইবো, বলেন? মানলাম, শীত-বসন্তের এই সন্ধিকালে প্রতিবারই এদেশে ভাইরাস জ্বরের প্রকোপ বাড়ে। কিন্তু এইরকম মহামারির মতো দেখিনি তো আগে! আগে তো ভাইরাসের মধ্যেও বসন্তকালে বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ ভেসে আসতো লিলুয়া বাতাসে। এখন তো আসে না! বসন্ত আসে; বাতাসও ওঠে। কিন্তু, সেই বাতাসভরা শুধু ভাইরাস!!!
কেন এমন বদলে যাচ্ছে আমাদের প্রিয় গ্রহটা? গ্রহের ভেতরের প্রাণদায়ী জল বায়ু আলো মাটি- সব? অনেকেই জেনে গেছি, বিশ্বজুড়ে কার্বন পোড়ানোর মচ্ছবই এই সর্বনাশা পরিণতির বড় কারণ। এই অনেকের মাঝে এগিয়ে আছেন সাংবাদিকসমাজ। কিন্তু সাংবাদিক বন্ধুরা আমার, এই অস্তিত্বনাশী গুরুতর বিষয়টি নিয়ে আমরা কী ভাবছি? কী করছি? বিশ্বের বেশিরভাগ বিজ্ঞানী-গবেষক-বিশেষজ্ঞের মতো সাংবাদিকদেরও প্রধান চিন্তা ও কাজের বিষয় এখন এটাই। কিন্তু আমরা কি যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে সাংবাদিকতাটা করছি এই বিষয়ে?
জানি, বুঝি- একে তো জীবিকার যন্ত্রণা, পেশাগত পেষণ; তার ওপর রাষ্ট্রযন্ত্রের দূষণ, শোষণ, নিপীড়নে পিষ্ট-ক্লিষ্ট সমাজের দর্পণ- সেই দর্পণে কি আর জলবায়ু, আলোমাটির ছবি আসে? সাংবাদিকের চোখে তাই আগে ভাসে দেশ-সমাজ-জীবনের ওইসব ভয়াল চিত্র। আমরা ব্যস্ত থাকি সেইসব ক্ষয়-অবক্ষয়ের নিউজ নিয়ে; নিজের অজান্তেই ভুলে থাকি আমাদের আদিপ্রাণদায়ী সেই আলো বাতাস মাটি পানির কথা।
কিন্তু বন্ধুরা, আমাদের জীবন কারো অর্ধেক, কারো বা তারও বেশি পেরিয়েই গেছে। এখন আমাদের ঘরে যে সন্তানেরা আছে, তাদের ফুটফুটে, মায়াবী মুখগুলোর দিকে তাকান। কী হবে ওদের? ওরা হয়তো সুবোধ সাংবাদিকের উত্তরাধিকারে পাওয়া রক্ততেজে ওদের দেশ থেকে, সমাজ থেকে, জীবন-জীবিকা থেকে সমস্ত জঞ্জাল ঝেঁটিয়ে বিদায় করে নেবে। কিন্তু যে বিষাক্ত জল-হাওয়া-আলো-মাটির পৃথিবীটা রেখে যাবো আমরা, তার মাঝে কী করে বাঁচবে আমাদের কলিজার ধনেরা? একবার ভাবেন তো কথাটা; দেখেন তো, কলিজাটা কেঁপে ওঠে কি না?
বন্ধুরা, আসুন, আমরা আমাদের প্রাণপ্রিয় বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেদের জীবিকার যন্ত্রণা আরেকটু বাড়িয়ে নিয়ে হলেও, যাকে বলে ‘পরিবেশ সাংবাদিকতা’; সেইটার দিকে মনোযোগী হই। যারা পরিবেশ-প্রকৃতিকে ধ্বংস করছে; দেশটাকে, পৃথিবীটাকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে; তাদের মুখোশ খুলে দিয়ে চিহ্নিত করে দিই। ওরা যেইভাবে অপকর্মটা করছে, তাদের সেই অশুভ কৌশলগুলো উন্মোচন করে দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলি। আমার বিশ্বাস, দেশ-সমাজ, জীবন-জীবিকার শত্রুদের নিয়ে যেভাবে যতোটুকুই সাহসিকতা দেখাতে পারছি; পরিবেশের পিশাচদের নিয়ে তার চেয়ে অনেক বেশিই সাহসী সাংবাদিকতা করার সুযোগ রয়েছে। আসুন, আমরা সাংবাদিকসমাজ সেই সুযোগটা কাজে লাগাই; এবং আমাদের সোনামণিদের জন্য সুন্দর একটা পৃথিবী নিশ্চিত করে যাই।
লেখকঃ তৌহিদুর রহমান