রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:১৮ পূর্বাহ্ন
বর্তমান বাংলাদেশের প্রতীকী ছবি
৭১ দেখিনি বলে মনের মধ্যে একটা আক্ষেপ ছিল। জুলাই মাসের শুরু থেকে দেশের ছাত্র আন্দোলন দেখে সেই আক্ষেপটা মিটে গেলো। সেইসঙ্গে আমরা নতুন করে সাক্ষী হলাম একাত্তরের ভয়াবহতার। প্রত্যক্ষ করলাম দেশের নিরীহ ছাত্রদের ওপর সরকারি পেটোয়া বাহিনীর অত্যাচার। দেখলাম সরকারি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্মমতা।
এছাড়াও দেখলাম দেশের সাধারণ মানুষ কীভাবে এই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা জানালো। দেশের বিবেক শিক্ষকেরা কীভাবে এই আন্দোলনে তাদের সমর্থন ব্যক্ত করলো। প্রবাসীরা কীভাবে দেশের আন্দোলনের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করলো। প্রবাসী দ্বিতীয় প্রজন্ম যাদের জন্ম বিদেশের মাটিতে তারাও একটা সময় এই আন্দোলনের জোরালো কণ্ঠস্বর হয়ে গেলো।
পাশাপাশি এক শ্রেণির মানুষ নিজেদের আখের গোছাতে শুরু করলো। তারা তো এতদিন চাটুকার ছিলই গত কদিনে তারা মোসাহেবির চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলো। তারা টিনের চশমা চোখে দিয়ে দেশে কোনো আন্দোলন দেখতে পেলো না। আর দেখতে পেলেও সেটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেই জাহির করতে লাগলো। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বর্বরোচিত কর্মকাণ্ডের তারা একটা অলীক ব্যাখ্যা দিতে লাগলো। কিন্তু এই প্রবীণ এবং অচল প্রজন্ম জানে না যে জেনারেশন জি অনেক বেশি আধুনিক।
তাদের শুধু শক্তি প্রয়োগ করে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। বাস্তবেও সেটাই হয়েছে। দেশে একটা গণহত্যা হয়ে যাবার পর তারা আবার নতুন মনোবলে বলীয়ান হয়ে আন্দোলনে ফিরে এসেছে। তারা তাদের ভাইবোনের রক্তের হিসাব বুঝে নিতে চায়। তারা জানতে চায় কি অপরাধে একটা স্বাধীন দেশে এত রক্তপাত হলো।
আন্দোলনের একেবারে শুরুর দিকে নজর দেওয়া যাক। জুলাইয়ের এক তারিখ থেকে ছাত্ররা প্রতিবাদ করতে শুরু করে। কি বিষয়ে আন্দোলন সেটা এখন দিবালোকের মতো পরিষ্কার তাই সেই বিষয়ে কথা বলছি না। আর আমি ছাত্র বলতে এই লেখায় ছাত্রছাত্রী উভয়কেই বুঝিয়েছি। এই আন্দোলনকে দেশের সরকার মোটেও আমলে নেয়নি। তাদের ব্যাপারটা এমন রাজপথে আন্দোলন করে যেই দলের জন্ম সেই দলকে আন্দোলন শেখাতে এসো না।
ছিয়াত্তর বছর বয়সী দলের কাছে তোমরা নিতান্তই শিশু যাদের এখনো দুধের দাঁত পড়েনি। এতো গেলো অবজ্ঞা করার ব্যাপার। উপরন্তু অতি আত্মবিশ্বাসী দলপতি এবং সরকার প্রধান তার চিরচেনা সুরে আন্দোলনকারীদের নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা শুরু করলেন। এটা একজন সাধারণ নেতা বা একজন সাধারণ মানুষ করলে সেটা হয়তোবা শোভন হতো কিন্তু একজন সরকার প্রধানের এমন অভিব্যক্তি আন্দোলনে যেন ঘি ঢেলে দিলো। এরপর থেকে সেই আগুন জ্বলছে।
আমি এখানে তারিখগুলোর উল্লেখ করছি না শুধু ঘটপট প্রবাহের দিকে নজর রাখছি। সরকার প্রধানের এমন চটুল যুক্তিতে আন্দোলনকারীরা নিজেদের রাজাকার অভিদা দিতেও পিছপা হয়নি। যে দেশে রাজাকার, আলবদর, আলশামস ছিল সবচেয়ে ঘৃণিত শব্দ সেই শব্দই ছাত্ররা উচ্চারণ করলো। তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে ছাত্ররা কি সত্যিই নিজেদের রাজাকার পরিচয় দিয়ে গর্বিত হলো। বিষয়টা মোটেও এমন সরল সহজ না। যদিও এই একটা স্লোগানকে ধরেই আমাদের বেতনভুক্ত বুদ্ধিজীবীরা ছাত্রদের ন্যায্য আন্দোলনকে একটা বিতর্কিত বিষয় করে তুলতে চাইলো। ছাত্ররা কেন নিজেদের রাজাকার বললো সেই দিকে একটু নজর দেওয়া যাক।
দেশ গত পনেরটা বছর একটা দল নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে শাসন করে যাচ্ছে। কাগজে কলমে একটা বিরোধী দল অবশ্য আছে। তাদের অবস্থা ‘ঢাল নাই তলোয়ার নাই নিধিরাম সর্দার’র মতো। একটা বিরোধী দল রাখতে হয় তাই রাখা। যারা চলে সরকারি দলের ছত্রছায়ায় এবং অনুগ্রহে। এতে করে দেশের মানুষের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আসলে কোনো বিতর্কের অবকাশ তৈরি হয়নি।
যেহেতু সরকারি দল একটা লোক দেখানো নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে তাই তারা জনমতকে পাত্তাও অবশ্য দেয় না। তারাই দেশের সবচেয়ে ভালোটা বোঝে এবং তারাই শুধুমাত্র দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের কথা ভাবে। সরকার প্রধান এবং তার সাগরেদদের কথাবার্তায় সেটা খুবই স্পষ্ট।
তারা অবশ্য দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেছে যেটা খালি চোখেই দৃশ্যমান। ঢাকা শহর ঢেকে দেওয়া হয়েছে বিশাল বিশাল সব কংক্রিটের ছাদে। সেগুলোর অবশ্য গালভরা নামও আছে- ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল ইত্যাদি। এতে করে একটা সবুজবিহীন শহরের জীবনমানের কতটা উন্নয়ন হয়েছে সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ।
দেশের সরকার এবং আমলারা যখন যেটা ভালো বুঝেছে সেটা করে ফেলেছে। দরকার হলে পরবর্তীতে নতুন বাজেট করে সেটা সরানো হবে। দেশের সবচেয়ে বড় এবং প্রশস্ত নদী পদ্মাকে শাসন করা গেছে। যার ফলে দক্ষিণবঙ্গের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির সাথে রাজধানীর যোগাযোগ সহজ হয়েছে।
এসব উন্নয়ন দেশের মানুষের জীবনমান পরিবর্তনে কতটা প্রভাব ফেলেছে সেটা নিয়ে গবেষণা হতেই পারে। কিন্তু এসব উন্নয়নের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দুর্নীতি। সরকার, সরকারি দল, তাদের পোষ্য ছাত্র সংগঠন থেকে শুরু করে আমলা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়েছে।
তারা সবাই দুর্নীতি করে দেশে অঢেল ধনসম্পদের মালিক হবার পাশাপাশি দেশের টাকা বিদেশে পাচার করার এক মহোৎসবে মেতে উঠেছে। অথচ এই টাকা তাদের নিজেদের কোনো টাকা না। এটা দেশের আপামর সকল জনসাধারণের টাকা। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রিজার্ভ চুরির মতো ঘটনা ঘটেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসীরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে সরকার এবং তার কর্মকর্তাদের অবহেলায় সেটা চুরি হয়ে গেছে।
এখন পর্যন্ত পরিষ্কার না যে আসলে কত টাকা চুরি গেছে। সেটা নিয়ে লোক দেখানো তদন্ত হয়েছে কিন্তু কাউকেই এর দায় স্বীকার করতে দেখা যায়নি। মজার ব্যাপার হচ্ছে যে সরকারি দল ডিজিটাল বাংলাদেশ স্লোগান নিয়ে দেশ শাসন করছে তাদের সময়েই এই ডিজিটাল চুরির ঘটনা ঘটেছে। এরচেয়ে দুর্ভাগ্যের ব্যাপার আর কি হতে পারে।
দেশের জীবনমান উন্নয়নের অনেক তথ্য আমাদের সামনে এসেছে। সেগুলো দেখে মনে হয়েছে আসলেই আমাদের অভাগা দেশটা যেন এতদিনে সত্যিকারের সোনার বাংলা হয়ে গেছে। কিন্তু শুভংকরের ফাঁকি’র মতো আমরা জানতে পারলাম এইসব তথ্যের বেশিরভাগই ভিত্তিহীন এবং মনগড়া। এটা যে কি ভয়ংকর একটা ব্যাপার সেটা যে কেউই বুঝবে।
এসব বিষয় নিয়ে যখনই কেউ কিছু বলতে গেছে তাকে রাজাকার ট্যাগ দিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। সার্বিকভাবে বিষয়টা এমন দাঁড়িয়েছে যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলের ক্ষমতার বিরুদ্ধে মুখ খোলা মানেই রাজাকার হয়ে যাওয়া। কি ভয়াবহ একটা ব্যাপার। ক্ষমতাসীন দল এবং তার আজ্ঞাবাহী সরকারি কর্মকর্তারা যত বড়ই পুকুরচুরি করুক তাদের কিছুই বলা যাবে না।
তাহলে হীরক রাজার দেশের মতো যন্তরমন্তর ঘরে পাঠিয়ে মগজ ধোলাই করে তাকে রাজাকার বানিয়ে দেওয়া হবে। তাই শিক্ষার্থীরা যে নিজেদের রাজাকার ঘোষণা করেছে এতে আমি বিশেষ অবাক হইনি। দীর্ঘদিনের অন্যায় অত্যাচারের ফলাফল নিজেকে রাজাকার উপাধি দিতে বাধ্য করেছে। কারণ সরকারি দলের আচার আচরণ এমন যে দেখে মনেহয় দেশে দুই রকমের মানুষ আছে- সরকারি দল আর রাজাকার। সেই হিসাবে সরকারি দল এবং তাদের মোসাহেবরা ছাড়া সবাই যেন রাজাকার।